গুরু-শিষ্য লক্ষণ
সমগ্র শিক্ষণ বিষয়েই ওরুর দরকার হয়। শুরু ছাড়া জ্ঞানলাভ হয় না। সেজন্যই শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে—
“অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জনশলাকরা।
চক্ষুরুন্মিলীতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ॥”
অর্থাৎ গুরুদেবই কেবল জ্ঞানরূপ কাজলের দ্বারা অজ্ঞানের অন্ধকার নাশ করে তিনিই জ্ঞান-চক্ষু প্রদান করে থাকেন। সেই গুরুকে আমরা প্রণাম করি। সাধনার পথে এগোতে হলে, পথ-প্রদর্শকরূপে গুরুর প্রয়োজন হয়। তার আদেশ এবং উপদেশ শিরোধার্য করে কর্ম বা সাধনপথে এগিয়ে যেতে হবে।
আধ্যাত্মিক সাধনার পথেই হোক বা কর্মজীবনের পথেই হোক, তাতে সিদ্ধিলাভ করতে হলে বা সার্থক করতে গেলে গুরুকেই প্রয়োজন হয়। গুরুর করুণা এবং তার নির্দেশিত পথই সাধনপথের একমাত্র পাথেয় বলে মেনে চলতে হবে। যিনি কঠোর সাধনার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করেন, এইরকম সিদ্ধসাধকই গুরু হওয়ার যোগ্য। কিন্তু বর্তমানে এইপ্রকার সিদ্ধ গুরু দুষ্প্রাপ্য; কিম্বা যাঁরা আছেন, তাঁরা লোকচক্ষুর অন্তরালে বসবাস করেন। কদাচিৎ কোনও অতি ভাগ্যবান ব্যক্তি এইপ্রকার সদ্গুরুর আশীর্বাদে ধন্য হন।
এইরকম সিদ্ধ সদ্গুরুর সন্ধান যদি না পাওয়া যায়, তাহলে তন্ত্রের সৃষ্টিকর্তা মহেশ্বরকে মনে মনে সদ্গুরুরূপে মেনে নিয়ে সাধনা করতে হবে। সাধনসম্পর্কের পাঠ্যগ্রন্থসমূহ পাঠ করে সেরকমই নিয়ম, আচার-অনুষ্ঠান করা প্রয়োজন।
সাধককে তার মনের মত সুশীল সদ্গুরু বেছে নিতে হয়। এজন্য অরণ্যবাসী ও গুহাবাসী সন্ন্যাসী, শ্মশানবাসী ও মঠাধ্যক্ষের সান্নিধ্য না হলেও চলে। যে কোন সদ্গুণী সংসারী মানুষও শুরু হবার যোগ্য। এইজন্য তাঁর নিম্নলিখিত সদ্গুণগুলির প্রয়োজন আবশ্যক।
১। শিষ্যের আপন দেশবাসী, ঈশ্বরবিশ্বাসী, নিত্যপূজা-পাঠকারী এবং বর্ণাশ্রমের | চারটি ধাপ আশ্রমের সঙ্গে থেকে পালন ও আচরণকারী হওয়া প্রয়োজন ৷
২। সদাচারী, সত্যবাক্, শান্ত-সৌম্য ব্রাহ্মণ হওয়া দরকার।
৩। যাঁর মনে কাম, ক্রোধ, লোভ, হিংসা ও ছলনা নেই ও যিনি অন্য সমস্ত কু-কর্ম থেকে নির্লিপ্ত থাকেন অর্থাৎ সহজ, সরল ও পবিত্র জীবনযাপন করেন, তিনিই গুরুপদবাচ্য।
৪। যিনি চরিত্রহীনতা, বিলাসপ্রবণতা, প্রসাধনপ্রিয় ও চঞ্চলতা থেকে মুক্ত, তিনিই গুরুপদবাচ্য।
৫। যিনি সামাজিক কুসংস্কার মুক্ত, রাজনীতি ও ষড়যন্ত্র কিছুতেই লিপ্ত নন, তিনিই গুরু হওয়ার যোগ্যপুরুষ।
৬। আশ্রমনিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ণ, পরোপকারী, সংযমী, শাস্ত্রাধ্যয়নকারী, স্থিরচিত্ত মৃদুভাষী তিনিই শুরু হওয়ার যোগ্য।
৭। নম্র, বিনয়ী, ব্রাহ্মণের ধর্মপালনকারী, মেধাবী, আস্থাবান, বিবেকী তিনিই সদ্গুরু।
এছাড়া নিম্নলিখিত চিহ্ন বা ব্যাধি থাকলে তাকে গুরুপদে বরণ করা যায় না।
১। পঙ্গু, একচক্ষু, খঞ্জ, একহাতবিশিষ্ট অঙ্গহীন ব্যক্তি গুরুর যোগ্য নন।
২। যার দেহে শ্বেতী বা শ্বেতকুষ্ঠ আছে।
৩। অধিক অঙ্গ যুক্ত,
৪। বিকৃতাঙ্গ,
৫। ছলনাকারী, প্রতারক, বিলাসী, শঠ, লোভী, আলসী,
৬। অমিতাহারী, ভোজনবিলাসী,
৭। গুরুনিন্দাকারী, হিংসুক, পরশ্রীকাতর, অজ্ঞাতকুলশীল, দম্ভী, অজ্ঞানী, অশিক্ষিত,
৮। কুৎসিত দেহধারী, বিকৃত নখ, চক্ষুদোষ ও কালো দত্তযুক্ত,
৯। চরিত্রহীন, বিষয়ভোগী, কলহপ্রিয়, তার্কিক, অভিশাপগ্রস্ত, বাচাল, ধূর্ত, অবিশ্বাসী, নিত্যকর্মে বিমুখ,
১০। দয়া-মায়াহীন, কর্কশ-স্বরযুক্ত, নারীচর্চাকারী, বিষয়লোভী, সঞ্চয়ী, অপরাধী, ক্ষমা ও দয়াহীন।
উপরোক্ত লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিগণ পাতকী হয়। এইসব অশুভ লক্ষণ থাকলে তাদের সংস্পর্শে আসাও পাপ, এদের গুরু করা যায় না।
দীক্ষাগ্রহণ সম্পর্কে জ্ঞাতব্য বিষয়
উপযুক্ত গুরু পাওয়া গেলে দীক্ষাগ্রহণ করবেন। দীক্ষার অর্থ গুরুর দ্বারা শিষ্যকে ইষ্টমন্ত্র প্রদান। গুরুদেব দীক্ষাপ্রদান করার সঙ্গে সঙ্গে সাধনাসম্পর্কে শিক্ষাও প্রদান করে থাকেন। সাধনা একপ্রকার নয়, বিভিন্ন উদ্দেশ্য সিদ্ধিলাভের জন্য বিভিন্নরকম সাধনা আছে এবং বিপদের সম্মুখীন হলে সর্বতোভাবে রক্ষা করে থাকেন। শিষ্যেরও উচিত সর্বদা গুরুর উপদেশ ও আদেশ যথাযথভাবে পালন করা। গুরু সম্মুখে থাকলে কোনরকম বাধা-বিঘ্নতা তার সাধনা ভ্রষ্ট করতে পারে না।
এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার—দীক্ষা যখন-তখন গ্রহণ করা যায় না, সেজন্য প্রথমে মুহূর্ত নির্ণয় করা প্রয়োজন; তারপর মাস, পক্ষ, তিথি, দিন, লগ্ন, নক্ষত্র, যোগ বিভিন্ন কিছু বিচার করে দেখতে হবে।
মুহূর্ত ও তার প্রভাব
দিন ও রাত্রির এক-একটি ভাগ এক-এক প্রকার বিশিষ্ট শক্তির দ্বারা সম্পন্ন হয়, একেই মুহূর্ত প্রভাব বলে। প্রহর, ঘণ্টা, পল একটি না একটি বিশিষ্ট প্রভাব সংযুক্ত হয়। আবার সেইসব প্রভাব বা শক্তি প্রত্যেকটি কাজেই সহায়তা করে না। কাজেই বিভিন্ন রকম কাজের জন্য বিভিন্নরকম বিশেষ মুহূর্তের প্রয়োজন পড়ে। যে মুহূর্তে চলা কাজ নির্বিঘ্ন ও ফলদায়ক। হয়, সেই মুহূর্তই হল শুভ মুহূর্ত। আবার কিছু সময় দেখা যায় যে মুহূর্তে নানা প্রকার শুভ কার্যানুষ্ঠানে বাধা বা বিঘ্নের সৃষ্টি হয় এবং কার্যে নিষ্ফলতা দেখা দেয়, তাকে অশুভ মুহূর্ত বলা হয়।
অনুকূল মুহূর্তে সাধনা শুভ ও ফলদায়ক হয়। প্রতিকূল মুহূর্তে সাধনা বা অন্য কোনপ্রকার শুভ কাৰ্যানুষ্ঠান শুধু নিষ্ফলই হয় না, সাধক বা কর্তার পক্ষে ক্ষতিকারক, এমনকি কর্তা বা সাধকের প্রাণহানিও ঘটতে পারে। এইসব অশুভ মুহূর্তে গুরুর প্রয়োজন আবশ্যক হয়ে পড়ে।
পক্ষ নির্ণয়— মুহূর্ত নির্ণয়ের পর পক্ষ নির্ণয় আবশ্যক। পক্ষ হলো দুটি—শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ। প্রতি পক্ষে আকাশে চন্দ্রের উপস্থিতি ১৫ দিন অস্তর ঘটে থাকে। এবার কোন পক্ষে কি কার্য বা কাজ শুভ ফলদায়ক, সে সম্বন্ধে নিম্নে আলোচনা করা হল।
১। কৃষ্ণপক্ষে দীক্ষা গ্রহণ করলে– আধ্যাত্মিক শুভফল লাভ, জ্ঞানলাভ, ঈশ্বর সান্নিধ্য ও মোক্ষলাভ হয়।
২। সাংসারিক কার্যে শুভফল লাভ করতে হলে, শুক্লপক্ষে দীক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।
তিথি-নির্ণয়— পক্ষ নির্ণয় হওয়ার পর দরকার তিথি নির্ণয় করা। চন্দ্রকলার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমণ্ডল ও সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদজগৎ প্রভাবিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে মানুষের অন্তরে চন্দ্রের প্রভাব খুব বেশী দেখা যায়।
দীক্ষাগ্রহণের শুভ তিথিগুলি হলো— দ্বিতীয়া, পঞ্চমী, সপ্তমী, দশমী, ত্রয়োদশী ও পূর্ণিমা।
দিন-নির্ণয়— তিথি নির্ণয় হলে দিন নির্ণয় করা প্রয়োজন।
দিন নির্ণয়ের শুভ দিনগুলি হলো— রবি, সোম, বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার। এছাড়া গুরুর আদেশ অনুসারে দিন নির্ণয় করা উচিত।
লগ্ন— দিন, ‘মুহূর্ত ও তিথি নির্ণয়ের পর লগ্ন নির্ণয় করা বিশেষ আবশ্যক। এজন্য শুভলগ্ন দেখে দীক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
সাধনা ও শুভকার্যের শুভ লগ্ন হলো— মেষ, কর্কট, বৃশ্চিক, তুলা, মকর এবং কুম্ভ প্রশস্ত লগ্ন।
নক্ষত্র-নির্ণয়– লগ্ন বিচার করার পর প্রয়োজন নক্ষত্র নির্ণয় করা। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, সর্বশ্রেষ্ঠ শুভ নক্ষত্র হল পুষ্যা নক্ষত্র। এছাড়া–হস্তা, অশ্বিনী, রোহিণী, স্বাতী, বিশাখা, জ্যেষ্ঠা, উত্তরফল্গুনী, উত্তরাষাঢ়া, উত্তর ভাদ্রপদ, শ্রবণা, আর্দ্রা, ধনিষ্ঠা এবং শতভিষাও প্রশস্ত। ভাদ্র মাসের ষষ্ঠী, আশ্বিনের ত্রয়োদশী (কৃষ্ণপক্ষের), কার্তিক মাসের শুক্লানবমী, শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথি বিশেষ শুভ ফলদায়ক।
কোন মাসে দীক্ষা গ্রহণের কি ফলাফল– চৈত্রমাসে দীক্ষাগ্রহণে নানারকমের সিদ্ধিলাভ হয়ে থাকে। এই মাসটি গোপাল মন্ত্র গ্রহণের পক্ষে শুভ।
এইভাবে বৈশাখে— অর্থলাভ, জ্যৈষ্ঠেতে—মারণকর্ম, আষাঢ় মাসে—কুটুম্বহানি, শ্রাবণ মাসে—–আয়ুবৃদ্ধি, ভাদ্রমাসে—সন্তানহানি। আশ্বিন মাসে—–রত্ন অর্থাৎ অর্থলাভ। কার্তিক এবং অঘ্রাণ মাসে—মন্ত্রসিদ্ধি। পৌষমাসে—বিদ্বেষণ কর্ম, মাঘমাসে—ঐশ্বর্য, জ্ঞান এবং বুদ্ধিলাভ, ফাল্গুন মাসে—মনোস্কামনা সিদ্ধ হয়ে থাকে।
দিনের প্রভাব- দীক্ষার ব্যাপারে দিনের প্রভাবের কথাও শাস্ত্রে বলা হয়েছে। যেমনঃ রবিবার—–আয়ুবৃদ্ধি, সোমবার শাস্তিলাভ, মঙ্গলবার—আয়ুনাশ, বুধবার—–সম্পত্তিলাভ, বৃহস্পতিবার—জ্ঞানলাভ, শুক্রবার–দুর্ভাগ্য এবং শনিবার—অপযশ।
তিথির প্রভাব— তিথি অনুসারে চন্দ্র এবং সূর্য্যের রশ্মির প্রভাব পৃথিবীর উপর নানাভাবে প্রকাশিত হয়। সেই কারণে ভিন্ন ভিন্ন তিথিতে ভিন্ন ভিন্ন তান্ত্রিককর্ম করা উচিত। তন্ত্রশাস্ত্রে এ বিষয়ে যা উল্লিখিত আছে, তা এখানে প্রকাশ করা হচ্ছে। যেমনঃ–
প্রতিপদে—অজ্ঞানতা। দ্বিতীয়া, তৃতীয়াতে—বুদ্ধিভ্রষ্টতা এবং অজ্ঞানতা। চতুর্থীতে— অর্থক্ষয়। পঞ্চমীতে—বুদ্ধির বিকাশ। যষ্ঠীতে— বুদ্ধিমান। সপ্তমীতে— সুখলাভ। অষ্টমীতে—মানসিক শক্তি বৃদ্ধি। নবমীতে রোগ-ব্যাধি ভোগ। দশমীতে—মান-সম্মান লাভ। একাদশীতে—–সদাচারী। দ্বাদশীতে—সর্ববিষয়ে সিদ্ধিলাভ। ত্রয়োদশীতে—অর্থহানি। চতুর্দশীতে—জন্মান্তরে পক্ষীযোনি প্রাপ্ত। অমাবস্যায় কর্মনাশ। পূর্ণিমায় —ধর্মবৃদ্ধি।
যোগ-এর প্রভাব— যতপ্রকার যোগের প্রভাবের কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, তার মধ্যে উল্লিখিত ১৫টি যোগ দীক্ষাগ্রহণের পক্ষে শুভ। যেমন— আয়ুষ্মানযোগ, প্রীতিযোগ, শোভনযোগ, বৃদ্ধিযোগ, সৌভাগ্যযোগ, ধ্রুবযোগ, শিবযোগ, ব্রহ্মযোগ, ইন্দ্ৰযোগ, সুকর্মাযোগ, বরীয়ানযোগ, সাধ্যযোগ, সিদ্ধিযোগ, হর্ষণযোগ, শুক্রযোগ।
দীক্ষাগ্রহণে শুভাশুভ নক্ষত্র
অশ্বিনী—মঙ্গলকারক। হস্তা—অর্থলাভ। রোহিণী – জ্ঞানবৃদ্ধি। চিত্রা—জ্ঞানলাভ। মৃগশিরা—সুখলাভ। স্বাতী—শত্রুহাসি। পুনর্বসু—অর্থলাভ। অনুরাধা—বন্ধুপ্রাপ্তি। পুষ্যা— শত্রুনাশ। মূলা—যশোলাভ। মঘা—দুঃখনাশ। শতভিষা—বুদ্ধিলাভ। পূর্বফল্গুনী—ঐশ্বর্য ও বুদ্ধিলাভ। পূর্বভাদ্রপদ—– সুখলাভ। উত্তরফল্গুনী – জ্ঞানবৃদ্ধি। রেবতী— যশোবৃদ্ধি।
অশুভ নক্ষত্র
ভরণী—মৃত্যুতুল্য। বিশাখা – দুঃখপ্রদ। কৃত্তিকা – দুঃখপ্রদ। জ্যেষ্ঠা— পুত্ৰনাশ । আর্দ্রা—মিত্রহানি। শ্রবণা—দুঃখপ্রদ। অশ্লেষা–মৃত্যুতুল্য। ধনিষ্ঠা—দরিদ্রতা।
উপযুক্ত ও অনুপযুক্ত আসন
১। ভূম্যাসন—মাটিতে বসে সাধনায় সাধকের হানি এবং মানসিক কষ্ট হয়।
২। পত্রাসন—পাতার তৈরী আসনে সাধকের উদ্বেগ, ভ্রম ও চাঞ্চল্য দেখা দেয়।
৩। তৃণাসন—ঘাস বা লতার আসনে সাধকের কীর্তি ও অর্থনাশ।
৪। কাষ্ঠাসন—কাঠের আসনে বসে সাধনায় ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে।
৫। বংশাসন—বাঁশের তৈরী আসনে সাধকের দুঃখ-দরিদ্রতা দেখা দেয়।
৬। বস্ত্রাসন বা চেয়ার— এই আসনে সাধকের রোগ-ব্যাধি ও অশান্তি হয়।
৭। প্রস্তরাসন— পাথরে বসে সাধনায় সাধকের পীড়া দেখা দেয়।
৮। মৃগচর্ম—এটি শ্রেষ্ঠ আসন। এতে সাধকের জ্ঞান ও সিদ্ধিলাভ হয়। কৃষ্ণসার মৃগের চর্ম অত্যন্ত প্রভাবশালী। তবে এটি দুষ্প্রাপ্য।
৯। ব্যাঘ্রচর্ম— এই আসনে সাধকের দরিদ্রতা দূর হয়ে মোক্ষলাভ হয়।
১০। কম্বলাসন— এতে দেহ-মনের ক্লেশ নাশিত হয়ে সিদ্ধিলাভ হয়।
১১। বেত্রাসন— বেতদ্বারা তৈরী আসনে সাধক শাস্তিলাভ করে।
১২। কুশাসন— এই আসনটি সর্বশ্রেষ্ঠ এবং অত্যস্ত সুলভ। এটি সর্বকার্যে শুভ।
দীক্ষাগ্রহণে শুভ স্থানসমূহ
নিম্নে উল্লিখিত স্থানসমূহ দীক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে শুভ ফলদায়ক। যেমন—
১। যেখানে গরু বাঁধা থাকে।
২। গোয়াল বা গোশালা।
৩। দেবমন্দির।
৪। অরণ্য।
৫। উপবন ।
৬। পর্বতের গুহা।
৭। নদীতট।
৮। গঙ্গাতীর।
৯। তীর্থস্থান।
১০। পর্বতশিখর
১১৷ তেঁতুল বৃক্ষ মূলে।
১২। শিবালয়।
অশুভ স্থানসমূহ
১। চন্দ্রনাথ পর্বত
২। মাতঙ্গক্ষেত্র।
৩। কন্যাগৃহ অর্থাৎ শ্বশুরালয়।
৪। গয়াক্ষেত্র
৫। সূৰ্য্যক্ষেত্র।
৬। বিরজাতীর্থ।
ভট্টগ্রাম
দীক্ষাগ্রহণের ব্যাপারে একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, সদ্গুরু যদি আদেশ দেন, তবে যে কোনো স্থানে এবং যে কোনো সময় দীক্ষা গ্রহণ করতে পারা যায়।
জপমালা
দীক্ষাগ্রহণের পর সাধক যে কাজের জন্য ক্রিয়াদি বা জপাদি করবেন, শাস্ত্রে বিভিন্ন মালা দ্বারা তার জপের নির্দেশ আছে। কোন্ কাজের জন্য কোন্ মালাদ্বারা জপ করলে ফলদায়ক হয়, এখানে তা উল্লেখ করা হল—
১। মারণ, উচাটন ও বিদ্বেষণাদি কাজে বা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পদ্মবীজের মালা খুবই প্রশস্ত।
২। পুত্রসন্তান লাভের জন্য পত্রবীজের মালা প্রশস্ত।
৩। সাত্ত্বিক এবং রাজসিক কামনাসিদ্ধির উদ্দেশ্যে রূপার মালা প্রশস্ত।
৪। কুশমূলের গাঁট দ্বারা নির্মিত মালা পাপমুক্তির জন্য প্রশস্ত।
৫। আয়বৃদ্ধি, অর্থলাভ ও লক্ষ্মীর কৃপা প্রভৃতির জন্য মুগার মালা প্রশস্ত।
৬। ত্রিপুরসুন্দরী সাধনার ক্ষেত্রে রক্তচন্দন কাঠের মালা প্রশস্ত।
৭। বগলামুখী বিষয়ে সাধনার ক্ষেত্রে হরিদ্রার মালা প্রশস্ত।
৮। ভৈরবী তন্ত্র সাধনার জন্য সাধক শঙ্খ, ফটিক, স্বর্ণ, মণি বা মুগার মালা ব্যবহার করলে সুফল পাবেন।
মালার অভাবে কর (হাতের আঙুল) জপ করার বিধিও আছে। কিন্তু এর ফল খুব কম হয়।
করজনে আটগুন পত্রবীজের মালায় দশগুণ, শঙ্খমালায় শতগুণ, মুগার মালায় সহস্রগুন, রত্ন মালায় দশসহস্রগুন, মতির মালায় লক্ষগুণ, পদ্মবীজের মালায় দশলণ্ডল, সুবর্ণের মালায় কোটিগুণ এবং কুশমুলের মালায় শতকোটিগুণ ফললাভ হয়ে
রুদ্রাক্ষ মালা
পুরাণগ্রন্থ অনুধাবন করলে জানা যায়— দক্ষের যজ্ঞস্থলে সতী শিবনিন্দা শুনে দেহত্যাগ করলে, সতীর বিরহে শিবের চক্ষু থেকে যে অশ্রু নির্গত হয়েছিল, তার থেকেই রুদ্রাক্ষের সৃষ্টি। রুদ্র অর্থে শিব, এবং অক্ষ অর্থে আঁখি বা চক্ষু। সুতরাং রুদ্র + অক্ষ = রুদ্রাক্ষ। যাই হোক, রুদ্রাক্ষ একপ্রকার ফলের বীজ। যতপ্রকার মালা আছে, তার মধ্যে রুদ্রাক্ষ সর্বশ্রেষ্ঠ। রুদ্রাক্ষ মালায় জপ করলে যে ফললাভ হয়, তার সংখ্যা প্রকাশ করা যায় না।
অতএব রুদ্রাক্ষ মালা ধারণ করতে হলে বেছে বা দেখে নিতে হবে। ভাঙা, পোকাধরা, জলে দিলে ভেসে ওঠে—এইরকম রুদ্রাক্ষ ফলদায়ক হয় না। এই মালা ধারণ করবার পূর্বে সংস্কার করে নিতে হয়। একবিংশতি (২১) প্রকার রুদ্রাক্ষ দেখা যায়। এর মধ্যে একমুখী রুদ্রাক্ষ খুবই মূল্যবান এবং দুষ্প্রাপ্য। আবার পনেরো মুখ থেকে একবিংশতি অর্থাৎ একুশ মুখ পর্য্যন্ত রুদ্রাক্ষ পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর।
রুদ্রাক্ষ ধারণের ফলাফল
১। একমুখী রুদ্রাক্ষ— এটি ধারণে মহাপাপ ক্ষয়, জ্ঞান, সাত্ত্বিকতা এবং সর্বসিদ্ধিলাভে প্রশস্ত। এতে ধন-ধন্যাদি ঐশ্বর্য্যবৃদ্ধির সঙ্গে দৈবী কৃপা লাভ হয়।
২। দ্বিমুখী রুদ্রাক্ষ— এটি চঞ্চলতানাশক, কামনা-বাসনাপূরক, এছাড়া বশীকরণ, ভূতাদি বাধা, মৃগী ও মূৰ্চ্ছারোগনাশক। এটি স্ত্রীলোকের অতি উপকারী।
৩। ত্রিমুখী রুদ্রাক্ষ— এটি ধারণ করলে সুখ-শান্তি, কাৰ্য্যসিদ্ধি, বিদ্যা ও জ্ঞানলাভ
৪। চতুর্মুখী রুদ্রাক্ষ— এটিকে পূজা, স্পর্শ এবং ধারণে সর্বপ্রকার মঙ্গল হয়।
৫। পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ— এটি কামনাপূরক মোক্ষ ও শান্তি দানকারী। এই রুদ্রাক্ষ হয়। সহজলভ্য এবং কমপক্ষে তিনটি ধারণ করা কর্তব্য।
৬। (৬ষ্ঠ) ষড়মুখী রুদ্রাক্ষ— এটি কার্তিকের অংশসম্ভূত। এর দ্বারা জ্ঞান-বুদ্ধির বিকাশ, এবং পাপনাশ ঘটে। বিদ্যার্থীদের পক্ষে খুবই উপকারী।
৭। সপ্তমুখী রুদ্রাক্ষ— এটি রোগ ও দুঃখনাশক, সুখ ও সিদ্ধিদানকারী।
৮। অষ্টমুখী রুদ্রাক্ষ— ভৈরবরূপী এই রুদ্রাক্ষ পাপ ধ্বংসকারী, আয়ু দানকারী, শিবলোক প্রাপ্তিদাতা।
৯। নয়মুখী রুদ্রাক্ষ—এটি নবদুর্গা স্বরূপা। এটি পরম কল্যাণদায়িনী এবং সুখ সৌভাগ্য বর্ধিণী।
১০। দশমুখী রুদ্রাক্ষ— শ্রীভগবান নারায়ণের কৃপাধন্য এই রুদ্রাক্ষ রোগ, শোক, দুঃখ ভুতাদি বাধা-বিঘ্ন অপসারণকারী এবং মনোবাঞ্ছাপূরক।
১১। একাদশমুখী রুদ্রাক্ষ— এটি মহানকার্যে এবং ঐশ্বর্য ও শ্রীবৃদ্ধির সহায়ক।
১২। দ্বাদশমুখী রুদ্রাক্ষ— সূর্যদেবের প্রিয় এই রুদ্রাক্ষ শ্রী, তেজস্বিতা ও শক্তিদায়ক।
১৩। ত্রয়োদশমুখী রুদ্রাক্ষ— এটি অভীষ্টলাভে অতীব ফলদায়ী।
১৪। চতুর্দশমুখী রুদ্রাক্ষ— এটি ভগবান মহেশ্বরের খুবই প্রিয়। এটি পাপ ধ্বংসকারী, সাত্ত্বিকতা বৃদ্ধিকারী এবং মোক্ষদানকারী।
রুদ্রাক্ষ ধারণের নিয়ম
রুদ্রাক্ষের মালা গেঁথে কণ্ঠে ধারণ করলেই ফললাভ হয় না। এটিকে লাল সুতা কিংবা সোনা, রূপা বা তামার তারের সাহায্যে প্রতিটিতে গ্রন্থি দিয়ে মালা তৈরী করতে হয়। এরপর পবিত্রাসনে উত্তরমুখে বসে ধূপ-দীপ জ্বেলে আচমন, বিষ্ণুস্মরণাদি করে পঞ্চগব্য, গঙ্গাজল বা তীর্থজলে স্নান করিয়ে রক্তচন্দন, বিল্বপত্র এবং অক্ষতাদির দ্বারা পঞ্চোপচারে যথাবিধি শিবপূজা করে, কমপক্ষে দশবার শিবগায়ত্রী জপ করতে হবে।
মন্ত্র যথা— ওঁ ত্র্যম্বকং মজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্দ্ধনম্।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্মূমৃত্যুমৃক্ষীয়মামৃতাৎ৷৷
কিংবা
“ওঁ তৎপুরুষায় বিদ্মহে মহাদেবায় ধীমহি, তন্নো রুদ্র প্রচোদয়াৎ।”
তারপর মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র— “ওঁ জুং সঃ” অথবা “ওঁ নমঃ শিবায়” মন্ত্রে বিল্বপত্র সমিধ দ্বারা ১০৮টি হোম করে তারপর শিবলিঙ্গে রুদ্রাক্ষমালা স্পর্শ করবার পর ধারণ করবেন। হোমের ভন্মদ্বারা তিলক নেবেন। মন্ত্র, যথা—
“ওঁ মহাদেব মহাত্মানং মহাযোগী মহেশ্বর।
মহাপাপ হরং দেবং মকারায় নমো নমঃ ॥”
অতঃপর মালাতে “ওঁ নমঃ শিবায়” – এই মন্ত্র ১০৮ বার জপ করে জপ শেষ করবেন। জপ সমাপন মন্ত্র, যথা— “ওঁ গুহ্যাতিগুহ্য গোপ্তা ত্বং গৃহাণাস্মত্ কৃতং জপম্ ৷ সিদ্ধিভবতু মে দেব তপ্ৰসাদান্মহেশ্বর।।”
শিষ্যের লক্ষণ
এর আগে গুরুর লক্ষণ সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে, এখন শিয্যের লক্ষণ সম্বন্ধে আলোচনা করা হল। নিম্নলিখিত দোষ-ত্রুটি যদি কারোর থাকে, তাকে শিষ্য হিসাবে মানা যায় না। যেমন—পাপাচারী, ঝগড়াটে, দুর্দান্ত প্রকৃতির, অত্যাচারী, হিংসুটে, কৃপণ, অবিশ্বাসী, অকৃতজ্ঞ, আচারভ্রষ্ট, আলস্যপ্রিয়, পরনিন্দুক, দীর্ঘসূত্রী দোষযুক্ত, লোভী, ক্রোধী, দুশ্চরিত্র, কপট, কটুভাষী, দুষ্কৃতকারী,শাস্ত্রের অবমাননাকারী,অশিক্ষিত, তোষামুদে, দন্তী ও অহংকারী, দুষ্ট-স্বভাব, চোর, প্রতারক, মিথ্যাবাদী, ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ও চঞ্চল প্রকৃতির প্রভৃতি স্বভাবযুক্ত মানুষ শিষ্য হওয়ার উপযোগী নয়।